বিশ্বনেতার জন্মদিনে
মোঃ আব্দুল মালিক
পরাধীন ভারতের পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮:০০ ঘটিকার সময় ভবিষ্যতের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশব থেকেই স্বাধীনচেতা ও একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। ০৭ বছর বয়সে গিমাডাংগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু। ১৯৩৪ সালে তিনি যখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র তখন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। কলকাতার নামী—দামী চিকিৎসকরা তাঁর চিকিৎসা করেন। প্রায় ২ বছর চিকিৎসার পর তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে তাঁর হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৩৬ সালে তাঁর চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। আবারও কলকাতার চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁর দুই চোখেই অপারেশন করা হয়। সেই সময় থেকেই তিনি চশমা পড়া শুরু করেন। অপারেশনের পর তাঁর চোখ দুটি ভাল হলেও চিকিৎসকদের পরামর্শে কিছু দিনের জন্য তাঁকে লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হয়। এ সময় তিনি স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর। গান্ধী পূর্বকালে ব্রিটিশ বিরোধী ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যতগুলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন তার মধ্যে অন্যতম। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন সুভাষ বসু। স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
আপাদমস্তক বাঙালি, খাঁটি মুসলমান, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী এই নেতা স্বদেশী আন্দোলনের পর যোগ দেন পাকিস্তান আন্দোলনে। তিনি কখনো স্বজাতি বা স্বধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন নি। উল্লেখ্য ১৯০৬ সালে ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ যখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন তখন তরুণ ব্যারিষ্টার, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস নেতা সরোজিনি নাইডুর সেক্রেটারি হিসেবে কংগ্রেসে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু কংগ্রেসে যোগ দেন নি।
১৯৪৭ সালে দ্বি—জাতিতত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। ৫৬% নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে ৭% নাগরিকের মাতৃভাষা ঊর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানীদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রুখে দাঁড়ান। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। বাঙালির উপর নেমে আসে অত্যাচার, নির্যাতন। ’৫২’র ভাষা আন্দোলন ’৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬’র ৬—দফা আন্দোলন, ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম এক যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য, গতিশীল নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসনের নিপীড়ন, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। তারা উল্টো বাঙালিদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু করে।
এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভার ডাক দেন। সেদিনের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা।
৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালি জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্খাকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণের দিক নির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। যার আবেদন আজও অম্লান। প্রতিনিয়ত এ ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে এবং অনাদিকাল ধরে অনুপ্রাণিত করে যাবে। এরপর জাতির পিতা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে জাতিসংঘের অন্যতম সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিষ্টার’ এ অন্তর্ভূক্ত করেছে।
গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ১৯৮৭ সালে বার্লিন দেয়াল ভেঙে চূর্ণ—বিচূর্ণ করার আহ্বান সংবলিত ভাষণ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারি ৪১ জন সামরিক—বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field, “We Shall Fight to The Beaches. The Speeches That Inspired History” শিরোনামে একটি ইতিহাস গ্রন্থ ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে অন্যান্যের মধ্যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া), জুলিয়াস সিজার (ইতালি), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ান বোনাপার্ট (ফ্রান্স), যোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (যুক্তরাষ্ট্র), ভস্নাদিমির লেনিন (রাশিয়া), উইড্রো উইলসন (যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাষ্কলিন রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সেতুং (গণচীন), হো চি মিন (ভিয়েতনাম) প্রমূখ নেতাদের বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এটা বাঙালি জাতির জন্য বিরাট গৌরবের বিষয়।
জাতিসংঘের অন্যতম সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ প্যারিসে অনুষ্ঠিত তাদের ৪০ তম সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ফলে ইউনেস্কোভূক্ত ১৯৫টি রাষ্ট্রে বছর ব্যাপী মুজিববর্ষ উদযাপন করার কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী কোভিড—১৯ এর কারণে তা যথাযথভাবে পালিত হয় নি।
২০২০ সালে জাতিসংঘ বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’আখ্যায়িত করেছে। ১৭ মার্চ ২০২২ খ্রিস্টাব্দে এই মহান নেতার ১০২ তম জন্মবার্ষিকী। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন নেতার জন্মশতবার্ষিকী জাতিসংঘ কতৃর্ক পালিত হয় নি। তাই জাতিসংঘ ঘোষিত একমাত্র বিশ্বনেতা হচ্ছেন বাঙালি ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের অবিসংম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কেবল সম্মানিত হন নাই, বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য এটি এক মহা আনন্দ, বিরল সম্মান ও গৌরবের।
খবর বিভাগঃ
কুশিয়ারা নিউজ