জকিগঞ্জে উপজেলায় দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র ঘোষণা করার পর থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে উপজেলাবাসীর মাঝে। নিজেদের মাটিতে গ্যাসের বিশাল মজুদ পাওয়ায় উপজেলার ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবী তুলেছেন উপজেলার সচেতন মহল। পাশাপাশি এ গ্যাসক্ষেত্রে উপজেলার বেকারদের চাকরি দেয়ারও দাবী তুলেছেন তারা।
এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা,পোস্ট, মন্তব্য এবং নতুন নতুন দাবী উত্তাপিত হচ্ছে।
ফেসবুকে ❤আমরা হক্কল জকিগঞ্জী❤ নামক গ্রুপে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে।
গ্রুপের এডমিন মো মোছলেহ্ উদ্দিন এবং মডারেটর জে এফ চৌধুরী ফাহিম লিখেছেন, 'জকিগঞ্জে গ্যাস সংযোগ চাই'।
গ্রুপের মেম্বার রাহেল আহমদ চৌধুরী লিখেছেন, 'জকিগঞ্জ গ্যাস ফিল্টে জকিগঞ্জের স্হানীয় যুবকদেরকে প্রথমে চাকরির সুযোগ করে দিতে হবে'।
আরেক মেম্বার আব্দুল মুমিন লিখেছেন, 'জকিগঞ্জের সব ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হোক'।
শিহাব উদ্দিন লিখেছেন, 'জকিগঞ্জের সর্বত্র গ্যাস সংযোগ দেয়া হোক'।
তাদের ছাড়াও আরোও শতশত মানুষ এসব দাবী তুলে ধরছেন।
এদিকে জকিগঞ্জ গ্যাস বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ফারুক আহমদ। তিনি জানিয়েছেন এ লক্ষে শিগগিরই শুরু হবে কর্মসূচি।
তিনি জানান আমাদের প্রধান দাবীগুলো হচ্ছে, জকিগঞ্জের প্রতিটি ঘরে গ্যাস সংযোগ প্রদান করতে হবে, গ্যাসক্ষেত্রে স্থানীয় যুবকদেরকে কর্মসংস্থান প্রদান করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে উপজেলায় গ্যাসনির্ভর শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে।
এছাড়া জকিগঞ্জের গ্যাসক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে পুরো সিলেটজুড়েও গ্যাস সংযোগ চালুর দাবি উঠেছে।
উল্লেখ্য, দেশব্যাপী গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার ফলে ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে সিলেটজুড়েও গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ রয়েছে। জালালাবাদ গ্যাসের অধীনস্থ এলাকা হয়েও সিলেটবাসী ওই সময় থেকে নতুন করে গ্যাস সংযোগ পাননি। সোমবার সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র ঘোষণার পর থেকে নতুন করে দাবি তুলেন সিলেটবাসী।
জকিগঞ্জের গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। সেখানে প্রায় ১২ থেকে ১৩ বছর পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। যার মূল্য হবে প্রায় ১২৭৬ কোটি টাকা। জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষে এনার্জি সিকিউরিটি: মডার্ন কনটেক্সট, চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে গ্যাসক্ষেত্র সন্ধানের তথ্য জানান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
আরও পড়ুনঃ সিলেটজুড়ে গ্যাস সংযোগ চালুর দাবি
এ ঘোষণার পর থেকে সিলেটে সচেতন মহলের মাঝে নতুন করে গ্যাস সংযোগ চালুর দাবি উঠে। তারা বলছেন, সিলেট জালালাবাদ গ্যাস এলাকাধীন থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন থেকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। নতুন করে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, তাই অনতিবিলম্বে সিলেটে সর্বত্র গ্যাসের আওতাধীন করার দাবি জানান তারা।
‘গ্যাস-সংযোগ বন্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন’ সিলেটের যুগ্ম আহ্বায়ক কমরেড আবু জাফর বলেছেন, সিলেটে অযৌক্তিক কারণে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে। গ্যাস সিলেটে উৎপাদন হয়, অথচ সিলেটের মানুষ গ্যাস পাচ্ছেন না। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে মূলত সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থে। আমরা গ্যাস সংযোগ বন্ধের গণবিরোধী সিদ্ধান্তের শুরু থেকে প্রতিবাদ করে আসছি। বিগত সংসদ নির্বাচনে শাসক দলের অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গ্যাস সংযোগের। কিন্তু এখন তারা ভুলে গেছেন। জকিগঞ্জের গ্যাসষ্কেত্র আবিষ্কার হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা সিলেটসহ সর্বত্র আবার আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ চালু হবে।
‘গ্যাস-সংযোগ বন্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন’ সিলেটের আহ্বায়ক ধীরেন সিংহ বলেন, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ, এর মালিক জনগণ। কিন্তু সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সিলেটে দীর্ঘদিন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। অনতিবিলম্বে তিনি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি সিলেটের সর্বত্র গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জোর দাবি জানান।
আরও পড়ুনঃ সিলেটজুড়ে গ্যাস সংযোগ চালুর দাবি
নাগরিক জোট সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ূম চৌধুরী বলেন, সিলেট জালালাবাদ গ্যাসের আওতাধীন এলাকা হওয়া স্বত্ত্বেও গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। কতিপয় লোকের স্বার্থের কারনে সিলেটবাসীকে তাদের ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।জকিগঞ্জে দেশের ২৮তম গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোর দাবি- সিলেটের সর্বত্র যেন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, জকিগঞ্জে গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া সিলেট সহ সারা দেশের জন্য সুখবর। আমাদের দাবি- আগে সিলেট বিভাগের সকল জায়গায় গ্যাস সংযোগ চালু করা হোক। এরপর দেশের যেকোন জায়গায় গ্যাস দেওয়া হোক।‘গ্যাস-সংযোগ বন্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন’ নেতাদের দাবি- সিলেট অঞ্চলে নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রাখার আদেশকে ‘বায়বীয়’। এর কারণ সম্পর্কে নেতারা বলেন, লুটেরা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রভাবে বায়বীয় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে শুধু জনভোগান্তি নয়, সরকারও রাজস্ব খাত থেকে কোটি কোটি টাকা বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি এক আদেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জালালাবাদ গ্যাসের অধীন এলাকা ছাড়া অনুমোদন সাপেক্ষে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়। এরপর সারা দেশে গ্যাস-সংযোগ বন্ধ থাকলেও সিলেটে চালু ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের ৮ জুলাই আরেকটি নির্দেশনায় জালালাবাদ গ্যাসকে একইভাবে সারা দেশের সঙ্গে নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত কমিটির অনুমোদন নেওয়ার অফিস আদেশ জারি হয়।
এরপর ৩ নভেম্বর থেকে সিলেটে নতুন সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।এ অবস্থায় ২২ ডিসেম্বর সাম্যবাদী দল সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক ধীরেন সিংহকে আহ্বায়ক করে ‘গ্যাস-সংযোগ বন্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন’ গঠন করা হয়। সিলেটের প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠনের নেতাদের ওই কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়।
৬ জানুয়ারি তাদের প্রথম সভায় ১০ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্দোলনের পক্ষে ১০ দিনের টানা গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু এতে কোন ফলপ্রসু হয়নি।এদিকে সোমবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রতিদিন প্রায় ১০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উত্তোলন করতে পারব। যেখান থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৩ বছর পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করতে পারব। যার মূল্য প্রায় এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, জকিগঞ্জে আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৬৮ পিসিএফ (প্রতি বর্গ ইঞ্চি) গ্যাসের সন্ধান আমরা পেয়েছি। এরপর থেকেই সিলেটবাসীর মনে নতুন করে গ্যাস সংযোগের আশা জাগে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি বাপেক্সকে ধন্যবাদ জানাই, তারা দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পেরেছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমি ধন্যবাদ জানাই। সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে জ্বালানি বিভাগের যে টিম এই কাজ করেছে তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। জকিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম আনন্দপুর গ্রামে সন্ধান পাওয়া এটি দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র।
বাপেক্স বলছে, এটি থেকে উত্তোলনযোগ্য ৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ আছে। সেখান থেকে গ্রিডে দৈনিক ১০ মিলিয়ন যুক্ত হবে। আর ১০ থেকে ১২ বছর গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হবে।এর আগে সিলেটের জকিগঞ্জে অনুসন্ধান কূপে দারুণভাবে সফলতার আলামত দেখে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)।
গত ১৫ জুন সকালে ডিএসটি (ড্রিল স্টিম টেস্ট) সৌভাগ্য শিখা জ্বালাতে সক্ষম হয় রাষ্ট্রীয় এ কম্পানিটি।কূপটির অভ্যন্তরে চাপ রয়েছে ৬ হাজার পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) আর ফ্লোটিং চাপ রয়েছে ১৩ হাজারের অধিক। প্রথমত একটি স্তরের টেস্ট চলমান। কূপটিতে মোট ৪টি স্তরে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বাপেক্স। নতুন এই ফিল্ডটি থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে বিয়ানীবাজার ও ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোলাপগঞ্জ।
আরও পড়ুনঃ সিলেটজুড়ে গ্যাস সংযোগ চালুর দাবি
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ওই সময় গণমাধ্যমকে বলেন, এখনই এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমরা ভালো কিছু আশা করছি, অনেক সময় পকেট থাকতে পারে। তাই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে, ঘণ্টা দুয়েক পর্যবেক্ষণের পর বলতে পারব। তার আগে বললে সেটি সঠিক না-ও হতে পারে।
এর আগে একটি সেমিনারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান ওই ফিল্ডটি সম্পর্কে বলেছিলেন, আমরা নতুন একটি ফিল্ডে সফল হতে চলেছি। সেখানে কূপের প্রেসার ৬০ হাজারের অধিক রয়েছে। পরীক্ষা চলছে, এটি আমাদের জন্য দারুণ সুখবর হতে পারে।
আশা করছি, খুব শিগগিরই ভালো খবর দিতে পারব।বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২৭টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।এসব গ্যাসক্ষেত্রে প্রমাণিত মজুদের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪ টিসিএফ, আরো ৬ টিসিএফ রয়েছে সম্ভাব্য মজুদ। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৮ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে।সে হিসেবে প্রমাণিত মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৩ টিসিএফ, আর সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে আরো ৭ টিসিএফের মতো।১১৩টি কূপ দিয়ে প্রতিবছরে উত্তোলিত হচ্ছে প্রায় ১ টিসিএফের মতো। এর মধ্যে দেশীয় কম্পানির ৭০টি কূপের (দৈনিক) ১ হাজার ১৪৫ এমএমসিএফডি, আইওসির ৪৫টি কূপের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১ হাজার ৬১৫ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট)। দৈনিক কমবেশি ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে।
গ্যাসের ঘাটতি মোকাবেলও এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত জুনে গণমাধ্যমে বলেন, ভালো কিছু সম্ভাবনা দেখছি। হয়তো বড় মজুদ হবে না। আমরা আরো বেশ কিছু গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি।